বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:৪০ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
এমপিওভূক্ত শিক্ষা জাতীয়করণের দাবীতে সহকারী শিক্ষক সমিতি এক দফা কর্মসূচিতে মিছিল। কালের খবর নবীনগরে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে অস্ত্র ও গুলিসহ গ্রেপ্তার ৬-। কালের খবর সর্বত্র তার ‘অশুভ’ হাত, দুর্নীতি-লুটপাটের বরপুত্র দুর্জয়। কালের খবর ইরানে সর্ষের মধ্যেই ভূত! কালের খবর শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম। কালের খবর ঈশ্বরগঞ্জে বালু উত্তোলনে বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি। কালের খবর নবীনগরে প্রাইভেট হাসপাতালের চিকিৎসককে হাত পা বেঁধে নির্যাতন, ১ জন গ্রেপ্তার। কালের খবর মাটিরাঙ্গা বাজার মনিটরিংয়ে ইউএনও-এসিল্যান্ড। কালের খবর সীতাকুন্ডে গাছে ঝুলন্ত অবস্থায় বৃদ্ধের লাশ। কালের খবর মিরপুর বিআরটিএ, যৌথ বাহিনীর সহায়তায় ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান-১৩ দালালের কারাদণ্ড। কালের খবর
শিক্ষা মানুষকে সুন্দর করে : আফতাব চৌধুরী। কালের খবর

শিক্ষা মানুষকে সুন্দর করে : আফতাব চৌধুরী। কালের খবর

 

।। আফতাব চৌধুরী, কালের খবর ।। 

‘যা কিছুই আমরা করি না কেন আমাদের উচিত তাতে উৎসর্গের ভাব নিয়ে করা।’ প্রতিবেশী দেশ ভারতের দ্বিতীয় প্রয়াত খ্যাতিস¤পন্ন দার্শনিক, শিক্ষক, ড. রাধাকৃষ্ণের দার্শনিক দৃষ্টি, মানব প্রেম এবং সত্য সন্ধানের উপলব্ধি কত গভীর তার উপরোক্ত উক্তিতে স্পষ্ট হয়ে উঠে। আমরা অনেকেই ভাবি যে, আমরা সত্যসন্ধান করছি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমরা সত্য থেকে অনেক দূরে থাকি। সত্যের নামে আমরা কথায়, কর্ম প্রবণতায় এবং পরচর্চায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এগুলো সত্যানুসন্ধানের প্রকৃত পথ থেকে আমাদের অনেক দূরে নিয়ে যায়।

সু-প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থার অঙ্গ হিসাবে শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের ঐতিহ্য তখনও ছিল এখনও আছে। সমাজ সব সময়ই শিক্ষককে এক স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অবলোকন করে থাকে। অবশ্য এরও কারণ রয়েছে, কেন না শিক্ষকের আচার- আচরণ ও কর্মধারাকে অনুসরণ করার একটা সহজাত ও স্বাভাবিক প্রবণতা গড়ে উঠে শিক্ষার্থীর মধ্যে। সে জন্য শিক্ষকের একটা সুনির্দিষ্ট ও সুনিয়ন্ত্রিত জীবন শৈলীর বাধ্যবাধকতা থাকে।

শিক্ষার ব্যাপারে শিক্ষকের চরিত্র, মাধুর্যপূর্ণ ব্যবহার, অক্লিষ্ট সহানুভূতি, সহনশীলতা, শান্ত, বিরক্তিহীন প্রকাশ ও দৃষ্টি এগুলোই হলো প্রধান সম্পদ। জন্মসূত্রে আমরা মানুষের পরিচিতি নিয়ে এলেও প্রকৃত অর্থে মনুষ্যত্বের স্বরূপ বা গুণাবলি বিকাশে শিক্ষক সমাজের দায় অনস্বীকার্য। সাধারণ মানুষ মনে করেন, শিক্ষক হলেন অপেক্ষাকৃত সৎ, দায়িত্বশীল, সংবেদনশীল ও বিবেকের প্রতিমূর্তি।

এক কথায় তারা সর্বৈব সৎ জীবনযাপন করে থাকেন। কিন্তু দৃশ্যত মানুষের সে বদ্ধমূল ধারণা ও প্রত্যাশার শেকড়ে এক কলস পানি ঢেলে দিয়ে কতিপয় শিক্ষক বিপথে পরিচালিত হচ্ছেন বলে বিভিন্ন মহলে কথাবার্তা শুনা যায়। যদি তাই হয় তাহলে আমরা বলব বাস্তব, অবাস্তব, যৌক্তিক, অযৌক্তিক কারণে তারা সমগ্র শিক্ষক সমাজকে পাঁকচক্রে জড়িয়ে ফেলছেন যা সর্বাবস্থায় দেশ ও সমাজের পক্ষে অত্যন্ত বেদনাদায়ক। কিন্তু একটা কথা মনে রাখতে হবে যে শিক্ষকের শিক্ষকতায় ছাত্রছাত্রীরা যথার্থ উপকৃত হয়, সে কৃতী শিক্ষকের কথা ছাত্রছাত্রীর মাধ্যমে অভিভাবক তথা সমাজের অন্যান্য মহলে গিয়ে পৌঁছায়।

ছাত্র ছাত্রীদের এ প্রশংসাসূচক প্রচারের ভিত্তিতেই সমাজ তাঁকে স্বীকৃতি দেয় ভালো শিক্ষকরূপে। সেজন্য শিক্ষকরা শিক্ষাদানে ইতিবাচক ভূমিকা না নিলে এর সফলতা পাওয়া কঠিন। কাজেই শিক্ষকতার মহান পেশাকে সম্মান জানাতে শিক্ষক সমাজেরই আগে সঠিক পদক্ষেপ নেয়া উচিত। কারণ এটা একটা মানব বিষয়ক বৃত্তি। এ বৃত্তির উপর আন্তরিকতা থাকাটা একান্ত আবশ্যক। শিক্ষক তার পেশাগত যোগ্যতা ও দক্ষতার মাধ্যমেই নিজস^ মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন এবং সম্ভবত এর কোনো বিকল্প নেই। তাই শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে সফলতা নিয়ে আসতে শিক্ষকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মনে রাখা প্রয়োজন শিক্ষার উদ্দেশ্য গাড়ি-ঘোড়া চড়া নয়, জীবনকে ফুটিয়ে তোলাই হল আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য এবং সকল গুণের বিকাশ সকল মাধুর্যের প্রকাশই সভ্যতা। শিক্ষার মুখ্য উদ্দেশ্য চরিত্র গঠন বা মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধন। চরিত্র মহৎ না হলে, মানুষের মতো না হলে, সকল শিক্ষাই ব্যর্থ হয়। চরিত্র ছাড়া শিক্ষার কোনো মূল্য নেই। ইংরেজিতে একটি মূল্যবান কথা আছে ‘If wealth is lost nothing lost, if health is lost something is lost, if character is lost everything lost’

আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত প্রকৃত মনুষত্বের গুণাবলিপূর্ণ একজন সৎ, নির্ভীক, শ্রেষ্ঠ মানব গঠন। তাই শিক্ষার প্রথম ও প্রধান উপকরণই হচ্ছে আদর্শ।

আদর্শই সমাজের মেরুদণ্ড, আর এ আদর্শ গড়ে তুলতে হলে জীবনের প্রতি যেমন থাকতে হবে ভালোবাসা, তেমনি থাকতে হবে জীবিকার প্রতি দক্ষতা। যে কোনো আদর্শে যুক্ত নয়, তার বুদ্ধিও হয় না, ভাবনাও সে করতে জানে না। আর যে ঠিকমত ভাবতে শিখেনি তার শান্তিই বা কোথায়, সুখই বা কোথায়। শিক্ষা মানুষকে বিনয়ী ও নম্র করে।

গাছ যখন ফলে পূর্ণ হয় তখন ফলভারে নত হয়ে যায়। বিদ্বান ব্যক্তিও এ কারণে বিনয়ী ও নম্র স্বভাবের হয়ে থাকেন। প্রকৃত বিদ্যালাভে মানুষের প্রবৃত্তিগুলো বিশুদ্ধ হয় ও নৈতিক মূল্যবোধ জাগরিত হয়। প্রকৃত শিক্ষা হচ্ছে, যা মানব প্রকৃতির অজ্ঞান আবরণ উন্মোচন করে পরিপূর্ণতার সহায়ক হয় এবং যে শিক্ষায় ব্যক্তির সুখে সমাজ সুখী হয় ও সমাজের সুখ অন্য সমাজের সুখের পরিপন্থী না হয়।

শিক্ষাই একমাত্র সম্পদ যার শেষ এবং বিনাশ নেই। বহু ত্যাগ ও সাধনার মাধ্যমেই মুষ্টিমেয় মানুষ এ চিরস্থায়ী সম্পদের অধিকারী হয়ে থাকেন। প্রাথমিক পর্যায় থেকে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক স্তর হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রত্যেক শিক্ষকই আমাদের সমাজ ব্যবস্থার মূল কাণ্ডারি। তাই খাঁটি শিক্ষক হতে হলে দেখে শুনে সুচারু কৌশল আয়ত্ত করা দরকার। সে ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক ও বাস্তবভিত্তিক হিসাবে ঠিক রাখা চাই নইলে ব্যর্থতা আসাই স্বাভাবিক।

শিক্ষকতার সাফল্যের প্রথম শর্ত জ্ঞানের সঙ্গে প্রয়োগ- নৈপুণ্যের সুষ্ঠু সমন্বয় সাধনের ক্ষমতা। কিন্তু এটুকুই যথেষ্ট নয়, এর সঙ্গে যুক্ত হওয়া দরকার অটুট কর্মনিষ্ঠা ও ছাত্রছাত্রীদের প্রতি স্নেহ, ভালোবাসা। তাই শিক্ষকের আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব প্রভাবিত করে ছাত্রকে। যেমন আলো দেখলে পোকামাকড় সে আলোর দিকে আকৃষ্ট হয়, ঠিক সেভাবে প্রকৃত শিক্ষকের সংস্পর্শে ছাত্রের সত্তাও বিকশিত হতে পারে, আর সে ক্ষেত্রে ছাত্রের মধ্যে শিক্ষকের যথার্থ গুণাবলির সমন্বয় ঘটা সম্ভব।

বাস্তব কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে কোনো শিক্ষক নিজের জনপ্রিয়তার যাচাই এর জন্য ছাত্রদের মন যুগিয়ে চলেন কিন্তু তার সিদ্ধান্ত তাকে মহান এর গোত্রভুক্ত করতে পারে না। একসময় তার কার্যকলাপ, তার পরশ্রীকাতর মনোবৃত্তি তাকে নিজেকেই ক্রমশ ছোট করে তোলে। নিজের ঢাক পিটিয়ে কখনও নিজের মান বাড়িয়ে তোলা যায় না, আদর্শ এবং উদ্দেশ্যের একীকরণ না হলে কেবল ভাঙনেরই সৃষ্টি হয়।

গেল ক’দশক ধরে শিক্ষাজগতে শিক্ষকের অবস্থান কোথায় সেটাই বিচার্য। সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা তুলনামূলকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এর পেছনে যেসব কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে তা হচ্ছে কোন কোন শিক্ষকের কর্ম সংস্কৃতি, শিক্ষা ব্যবস্থার ক্রম বিস্তার, শিক্ষক প্রশিক্ষণের নিম্নমান, পরিবর্তিত মূল্যবোধ এবং কিছুসংখ্যক শিক্ষকের সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে অনীহা ইত্যাদি। তবে এটাও সত্য শিক্ষকদের প্রতি সমাজের একটা সার্বিক উদাসীন দৃষ্টিভঙ্গি এ পেশাতে কিছুটা হলেও নিরুৎসাহজনিত পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে।

তাছাড়া বর্তমানে উপযুক্ত শিক্ষার একটা বড় অন্তরায় হচ্ছে কিছুসংখ্যক শিক্ষকের শেখার প্রতি অনীহা। কোন কোন শিক্ষক মনে করেন তার শেখার আর কিছু নেই। তাই অনেক শিক্ষকেরই বই-পত্রের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ থাকে না। ওই শিক্ষকের দ্বারা প্রকৃত শিক্ষাদানও সম্ভব হয় না। কারণ তাদের জ্ঞানের পরিধি থাকে সীমাবদ্ধ।

আজকের একবিংশ শতাব্দীতে সরকারি শিক্ষকদের বেতন, বাড়ি-গাড়ি, আসবাব-পত্র, টেলিভিশন, কোনো কিছুই দুর্লভ নয়, কিন্তু তারা হারিয়েছেন সম্মান। ছাত্র-ছাত্রীরা বাড়ি এসে কোন কোন শিক্ষক-শিক্ষিকা সম্বন্ধে অসম্মানসূচক মন্তব্য করে থাকে। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষা ফলপ্রসূ হতে পারে না। এ আকস্মিক পরিবর্তনের কারণ বিশ্লেষণ করলে মনে হয় পুঁজিবাদ আজ চরম সংকটে।

আজ সারা পৃথিবী অদ্ভুত এক প্রতিযোগিতায় নেমেছে। বিশ্বায়নের নামে প্রতিরোধহীন তৃতীয় বিশ্ব আজ প্রচণ্ড দুর্দিনের কবলে। বাংলাদেশ তার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষয়িষ্ণু। তাই আজ অধিকাংশ শিক্ষক কদার্থ পেশাদার। সমাজটা আজ ভোগবাদী, লোভবাদী ঠিকই, গণমাধ্যমগুলোও সেটাই প্রচার করে। শিক্ষকও যদি সে দর্শন দ্বারা পরিচালিত হন তাহলে আজকের প্রজন্ম যারা আগামী শতকের আলোকবর্তিকা হবে, কী করে পথ খুঁজে পাবে তারা?

তবুও আমরা আশাবাদী, শিক্ষকতায় আছে সততা,আছে পবিত্রতা। শিক্ষকই একজন ছাত্রকে আলোর পথের দিশা দেখান এবং পূর্ণ মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন। কাজেই পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার যাত্রায় সর্ব প্রথমেই শামিল হতে হবে শিক্ষককে। শিক্ষকরা পূর্ণত্বের দিকে যত এগিয়ে যাবেন, ততই ছাত্রছাত্রীদের উপর তার প্রভাব পড়বে এবং ছাত্রছাত্রীরাও স্বাভাবিকভাবেই পূর্ণত্বের দিকে অগ্রসর হবে এবং এতে শিক্ষকদের প্রতি তাদের সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ বাড়বে। পরিশেষে এটুকু বলা যায়, যে দেশের মানুষ যত বেশি শিক্ষিত সে দেশ তত উন্নত। শিক্ষা যে মানুষকে সর্বাঙ্গ সুন্দর করে শিক্ষাবিদ ওসমান গণী বা অধ্যাপক আবুল ফজলরাই তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাই বলতেই হয় শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

দৈনিক কালের খবর নিয়মিত পড়ুন এবং বিজ্ঞাপন দিন..

কালের খবর মিডিয়া গ্রুপ লিমিটেডের একটি প্রতিষ্ঠান
Desing & Developed BY ThemesBazar.Com